আনোয়ার সাঈদ তিতু, কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি:
কুড়িগ্রামের শহরের পূর্বপ্রান্তে ধরলা সেতুর ইজারা দরপত্রে লোকসানের পথ বেছে নিয়েছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ। মিথ্যা তথ্যে রাষ্ট্রের প্রায় দেড় কোটি টাকা লোকসান মেনে নিয়ে সুপারিশসহ মূল্যায়ন প্রতিবেদন পাঠিয়েছে সওজের কুড়িগ্রাম কর্তৃপক্ষ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত পছন্দের ঠিকাদারকে ইজারা পাইয়ে দিতেই অসত্য তথ্য উপস্থাপন করে লোকসানের পথ বেছে নিয়েছে সওজ। বিগত সময়ের চেয়ে সেতু দিয়ে যানবাহন পারাপার বাড়লেও পরিকল্পিতভাবে তথ্য গোপন এবং মিথ্যা তথ্য দিয়ে ইজারা মূল্য কম হওয়ার যুক্তি তুলে ধরেছে। এর ফলে বিগত তিন বছরের ইজারা মূল্যের চেয়ে প্রায় দেড় কোটি টাকা কম পাবে সরকার।
সওজ সূত্রে জানা গেছে, প্রতি তিন অর্থবছরের জন্য ধরলা সেতুর ইজারা আহ্বান করে কুড়িগ্রাম সওজ কর্তৃপক্ষ। ২০২১-২০২২, ২০২২-২০২৩ এবং ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে নির্বাচিত ইজারা মূল্য ছিল আট কোটি ৫৪ লাখ ৯৭ হাজার ২৪০ টাকা। ২০২৪ সালের ৩০ জুন আগের ইজারাদারের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। পরবর্তী ২০২৪-২০২৫, ২০২৫-২০২৬ এবং ২০২৬-২০২৭ তিন অর্থবছরের জন্য ২০২৩ সালের ২ অক্টোবর ইজারা দরপত্র আহ্বান করা হয়।। সওজ কর্তৃপক্ষের দাবি, একে একে ১৩ বার দরপত্র আহ্বান করলেও তেমন সাড়া মেলেনি।
দরপত্র মূল্যায়ন প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, প্রথম থেকে ৬ষ্ঠ এবং অষ্টম ও ১২তম আহ্বানে কোনও কোটেশন পাওয়া যায়নি। সপ্তম আহ্বানে দুটি, নবম ও ১০ম আহ্বানে তিনটি এবং ১১তম আহ্বানে দুটি কোটেশন পাওয়া যায়। কিন্তু এগুলোতে ইজারামূল্য সন্তোষজনক না হওয়ায় চলতি বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর ১৩তম বার দরপত্র আহ্বান করা হয়। তাতে দরপত্র দাখিল হয় একটি।
মূল্যায়ন প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ঘুরেফিরে তিনটি প্রতিষ্ঠান দরপত্র দাখিল করে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো কুড়িগ্রামের মো. লুৎফর রহমান বকসী, মো. মনিরুজ্জামান জনি ও পেন্টা ইঞ্জিনিয়ারিং। তবে সর্বশেষ ১৩তম কোটেশনে ছয়টি দরপত্র ডকুমেন্টস বিক্রি হলেও কেবল মো. লুৎফর রহমান বকসী দরপত্র দাখিল করেন। যার ইজারামূল্য বিগত বছরের তুলনায় দৈনিক ১৪ হাজার ৩৮ টাকা কম। যা তিন বছরে প্রায় দেড় কোটি টাকা।
বিগত ইজারা দরের তুলনায় প্রায় দেড় কোটি টাকা কম হলেও লুৎফর রহমান বকসীকে সর্বোচ্চ দরদাতা নির্ধারণ করে সুপারিশ করেছেন কুড়িগ্রাম সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নজরুল ইসলাম। গত ৭ অক্টোবর রংপুর সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বরাবর পাঠানো প্রতিবেদনে ধরলা সেতুর ট্রাফিক কাউন্ট সার্ভে সংক্রান্ত তথ্য উল্লেখ করে বেশ কিছু অসত্য ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ তথ্য উপস্থাপন করেছে সওজ।
প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, লুৎফর রহমান বকসীর দেওয়া দরের পক্ষে সাফাই দিয়ে সওজ বলেছে, ১৩ বার দরপত্র আহ্বান করেও প্রতিযোগিতা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এ ছাড়া জেলার ফুলবাড়ী উপজেলা হয়ে এলজিইডির আওতাধীন দ্বিতীয় ধরলা সেতু দিয়ে নাগেশ্বরী-কুলাঘাট রংপুর সড়কের দূরত্ব কম ও টোল ফ্রি। ফলে ভূরুঙ্গামারী ও নাগেশ্বরী উপজেলা তথা সোনাহাট স্থলবন্দরের অধিকাংশ যানবাহন ওই পথে চলাচল করে। এ ছাড়া দুধকুমার নদের ওপর সোনাহাট সেতু ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ভারী যানবাহনের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে বলে দাবি করেছে সওজ।
তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এলজিইডি কর্তৃক নির্মিত ফুলবাড়ীর দ্বিতীয় ধরলা সেতু হয়ে নাগেশ্বরী-ফুলবাড়ী-কুলাঘাট সড়কে শুরু থেকেই ভারী যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। ওই পথে লালমনিরহাটের কুলাঘাট এলাকায় রত্নাই নদীর ওপর সরু ও ঝুঁকিপূর্ণ বেইলি ব্রিজ দিয়ে ভারী যান চলাচল বন্ধ রেখেছে লালমনিরহাট সওজ। ফলে উল্লেখিত পথে বাস-ট্রাক কিংবা পণ্যবাহী ভারী যান চলাচল করে না। ফুলবাড়ী, নাগেশ্বরী ও ভূরুঙ্গামারী উপজেলাসহ সোনাহাট স্থলবন্দরগামী সব ভারী ও পণ্যবাহী যানবাহন কুড়িগ্রাম শহর হয়ে সওজের ধরলা সেতু পথে যাতায়াত করে। ফলে দ্বিতীয় ধরলা সেতু হয়ে নাগেশ্বরী-ফুলবাড়ী-কুলাঘাট পথে ভারী যান চলাচল নিয়ে সওজের প্রতিবেদন সঠিক নয়। মূলত পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ দিতে পরিকল্পিতভাবে লোকসান দেখানো হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে লালমনিরহাট সড়ক বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘কুলাঘাট হয়ে ফুলবাড়ী সড়কে ভারী যান চলাচল করে না। বেইলি ব্রিজটি ভার নিতে পারে না। ফলে সেতুটির ওপর ব্যারিকেড দিয়ে ভারী যান চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। রত্নাই নদীর ওপর আরেকটি সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। সেটির কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওই পথে ভারী যান চলাচল বন্ধ থাকবে।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে কুড়িগ্রাম সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘উপযুক্ত ইজারামূল্য পেতে আমরা ১৩বার দরপত্র আহ্বান করেছি। দেশের কোথাও এতবার ইজারা দরপত্র আহ্বান করা হয় না। আমরা মূল্যায়ন প্রতিবেদন পাঠিয়েছি। কর্তৃপক্ষ আরেকটি ট্রাফিক সার্ভে করতে বলেছে। সেটি পাঠানোর পর ইজারাদার নির্বাচনে কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেবেন।’